দেশীয় পর্যটকে এগোচ্ছে পর্যটনশিল্প 17/02/2018


দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে বাড়তি এক-দুই দিনের ছুটি পেলে এখন অনেকেই পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। আবার একদল তরুণ আছেন, নতুন দর্শনীয় স্থান আবিষ্কারের নেশায় সারা বছরই দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান। মানুষের এই ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতা কাজে লাগিয়ে দেশীয় পর্যটনশিল্প এখন ক্রমেই বাড়ছে। 

পর্যটন খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পর্যটকদের পছন্দের বেড়ানোর তালিকায় এক নম্বরে আছে কক্সবাজার। পরের অবস্থানে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি। পছন্দের তালিকার তৃতীয় অবস্থানে আছে সিলেট। হজরত শাহজালাল ও শাহপরানের মাজার জিয়ারত ছাড়াও সিলেটের চা-বাগানসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গাগুলোতে যাচ্ছেন পর্যটকেরা। বেড়ানোর তালিকায় আরও আছে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সেন্ট মার্টিন, পাহাড়পুর প্রভৃতি। ঘুরতে যাওয়ার জন্য ঢাকার খুব কাছে গাজীপুরের বিভিন্ন রিসোর্টও এখন বেশ জনপ্রিয়। 
পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) হিসাব অনুযায়ী, বছরে এখন ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান। বছর পাঁচেক আগেও এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ লাখ ছিল। আর ২০০০ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত ১৫ লাখ মানুষ। আর পরোক্ষভাবে আরও ২৩ লাখ লোক এ খাতের সঙ্গে যুক্ত। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এ খাত। আর্থিক মূল্যে দেশীয় পর্যটন খাতের আকার দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকার। 
সমুদ্র ও পাহাড় একসঙ্গে দেখার সুযোগ থাকায় কক্সবাজার দেশীয় পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। আগে শীতের মৌসুমে বেশি ভিড় থাকলেও এখন প্রায় সারা বছরই কক্সবাজারে পর্যটকদের আনাগোনায় মুখর থাকে। পর্যটকদের আবাসন সুবিধার জন্য কক্সবাজারজুড়ে এখন ৪৫০ হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে পাঁচতারকা মানের হোটেল যেমন রয়েছে, তেমনই আছে কম খরচে থাকার ব্যবস্থা। 
পরিবহন ব্যবসায়ীদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে গড়ে কমপক্ষে ১০০টি বাস ছেড়ে যায়। বাংলাদেশ বিমান ও তিনটি বেসরকারি বিমান সংস্থার প্রতিদিন গড়ে ১০টি ফ্লাইট কক্সবাজারে যায়। এ হিসাবে সড়ক ও আকাশপথে কক্সবাজারে যান বছরে ১৫ লাখ মানুষ। এ ছাড়া রেলপথে চট্টগ্রামে গিয়ে সেখান থেকে সড়কপথে ও ব্যক্তিগত গাড়িতে আরও ২-৩ লাখ লোক কক্সবাজারে যান। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ২০ লাখ পর্যটককে আতিথেয়তা দেয় কক্সবাজার।


পার্বত্য তিন জেলা পর্যটকদের প্রিয় হলেও এখানে আবাসনব্যবস্থা কম। তাই এখানে দিনে বেড়ানো পর্যটকের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু সিলেটে আবার বিষয়টি উল্টো। সিলেট চেম্বার অব কমার্সের হিসাবে, পুরো সিলেট শহরে এখন ৩২৫টি ছোট-বড় হোটেল রয়েছে। এর বাইরেও কিছু হোটেল আছে যেগুলো হিসাবের বাইরে। সব মিলিয়ে প্রতিবছর সিলেটে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ আসেন, যা দেশের ভেতরে পর্যটকসংখ্যায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। 
দক্ষিণাঞ্চলে পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য সুন্দরবন। বছরে আড়াই লাখ লোক এখন সুন্দরবনে বেড়াতে যান। উত্তরবঙ্গে পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে নওগাঁর পাহাড়পুর, বগুড়ার মহাস্থান ও দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির। এসব জায়গায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ পর্যটক যান। 
টোয়াবের সভাপতি তৌফিক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অভ্যন্তরীণ পর্যটক বৃদ্ধির মূল কারণ দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ। মানুষের আর্থিক সামর্থ্য এখন আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ট্যুর অপারেটরদের ব্যবসা আগের চেয়ে ভালো হচ্ছে।

অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার সমস্যা
খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের অনেক পর্যটনকেন্দ্রেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা নেই। আবার যেখানে অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে, সেখানে পরিকল্পিত উপায়ে কাজ হচ্ছে না। অপরিকল্পিত অবকাঠামোর সবচেয়ে বড় উদাহরণ কক্সবাজার। অতিরিক্ত পর্যটকের ভারে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও এখন হুমকির মুখে পড়েছে। একই অবস্থা তৈরি হয়েছে সুন্দরবন, সিলেটের রাতারগুল, জলারবনসহ বেশ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্রে। আবার বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র পর্যন্ত যাওয়ার যোগাযোগব্যবস্থাও ভালো নয়।


সরকারিভাবে দেশে পর্যটনশিল্পের প্রসারে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড কাজ করছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পর্যটনকেন্দ্র এবং এগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে ১৭টি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১০ সালে তৈরি জাতীয় পর্যটন নীতিমালায় এ বিষয়ে সমন্বয়ের কথা বলা হলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। 
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যদি তাদের উন্নয়ন ভাবনায় পর্যটনকে সম্পৃক্ত করে, তাহলেই এ খাতের প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব। এ জন্য পর্যটন বোর্ড চেষ্টা করে যাচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীর দুই পারে আলাদা পর্যটনকেন্দ্র তৈরির কোনো পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত নেই। অথচ এ প্রকল্প ঘিরে নদীভিত্তিক একটা পর্যটনব্যবস্থা সহজেই তৈরি করা সম্ভব।

কমছে বিদেশি পর্যটক
অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা বাড়লেও উল্টো অবস্থা বিদেশি পর্যটক আগমনে। দেশে এখন বছরে বিদেশ থেকে কত পর্যটক আসেন, এর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। তবে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশে গত সাত-আট বছর ধরে বিদেশি পর্যটক কমেছে। 
ইউএনডব্লিউটিওর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৩ লাখের কিছু বেশি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা কমে ১ লাখ ২৫ হাজারে নেমে এসেছে। বিদেশি পর্যটক নিয়ে এরপর আর কোনো তথ্য বাংলাদেশ থেকে ইউএনডব্লিউটিওকে দেওয়া হয়নি। একই সময়ে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালে পর্যটকসংখ্যা প্রতিবছরই বেড়েছে। যেমন ভারতে ২০১০ সালে বিদেশি পর্যটক ছিল ৫৭ লাখ ৭৬ হাজার, ২০১৬ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ১ কোটি ৪৫ লাখ হয়েছে। একাধিক দেশীয় ট্যুর অপারেটর কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেও বিদেশি পর্যটকসংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি জানা গেছে।

ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ভূমিকা
দেশীয় পর্যটনের প্রসারে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক একটা বড় ভূমিকা রাখছে। সুযোগ পেলেই দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তরুণেরা। সেই ভ্রমণের ছবি ও গল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের পর সেই স্থানে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন অন্যরা। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই রাতারগুল, বিছনাকান্দি, হামহাম, সাজেকের মতো বিভিন্ন জায়গা মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের মানুষের পাশাপাশি অনেক বিদেশিও ইন্টারনেটে এসব স্থানের বর্ণনা দেখে বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। অল্প পরিচিত কিংবা নতুন নতুন স্থান হয়ে উঠছে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। প্রযুক্তির ব্যবহার এবং তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে দেশের পর্যটন খাত গতিশীল হচ্ছে। 


 

Leave a Comment