ঘুরে আসুন হতংকুচো 25/04/2019


পথ হারানোর ব্যাপক সম্ভাবনা যেখানে হাতছানি দেয়, যে কোন সময় অসাবধানতা ডেকে আনতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা, পুরো পথ যেন এ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর এমন এক ভয়ংকর সুন্দর স্থানের নাম ‘হতংকুচো’। ‘হতংকুচো’ নামটা কেমন একটু উদ্ভট লাগছে না? প্রায় অপরিচিত একটি ট্রেইল বা ঝিরিপথ, কিন্তু যেমন দুর্গম তেমনি অসাধারণ। এই ট্রেইল খাগড়াছড়ি জেলার নুনছড়ি এলাকায় অবস্থিত। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ এই হতংকুচো ও মাতাই তুয়ারী সম্পর্কে জানেই না।

তো কিছু দিক আগে কয়েকজন বন্ধু মিলে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম হতংকুচোর খোজে। আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই এসে পৌঁছলাম খাগড়াছড়ি শহরে। অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই ফ্রেশ হয়ে  শাপলাচত্বর মোড়ে নাস্তা সেরে একটু আলো ফুটতেই রওনা হলাম মাইসছড়ির উদ্দেশ্যে। শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার রাস্তা। মাইসছড়ি থেকে মাহেন্দ্রতে নুনছড়ি এসে পৌঁছলাম। হাটের দিন হওয়াতে পাহাড়িদের মিলনমেলা বসেছে যেন। পাহাড়ের দূর দুরান্তের অধিবাসীরাও আসছে কলাসহ নানা ফসল নিয়ে। বেচাকেনা চলছে পুরোদমে।

বাজার থেকেই গাইড জোগাড় করে নিলাম মাতাইতুয়ারি ঝরনা হয়ে হতংকুচো ট্রেইলের জন্য। সময় একটু পেরুতেই কাঠফাটা রোদ শুরু হয়ে গেল। এখান থেকে দেবতাপুকুর যেতে প্রায় ১৭০০ সিঁড়ি পেরুতে হয়। আমাদের প্রথম গন্তব্য সেখানেই। সিঁড়ি ধরে ১৫ মিনিট উঠতেই গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হলো সবার। অথচ সামনে বিশাল লম্বা পথ পরে আছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে অবশেষে গুনতে গুনতে সিঁড়ি শেষ হলো। এসে পৌছালামা সুবিশাল দেবতাপুকুর সামনে। ত্রিপুরা ভাষায় এই পুকুর ‘মাতাই পুখির’ নামেই অধিক পরিচিত। চারদিকে ঘন সবুজ গাছপালায় ঘেরা এই পুকুর প্রকৃতির এক বিস্ময় বটে। কথিত আছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের জলতৃষ্ণা নিবারণের জন্য স্বয়ং জলদেবতা এ পুকুর খনন করেছেন। প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ছাড়াও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে সমবেত হয়ে থাকে। পুকুরের পাশেই আছে শিব মন্দির। দেবতা পুকুরে আসা পূজারিরা পুকুরে স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিয়ে থাকেন।

গোসল ও সবাই মিলে ছবি তোলায় ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে মাতাইতুয়ারি ঝরনার উদ্দেশ্যে ট্রেকিং শুরু করলাম। একের পর এক পাহাড় ডিঙ্গিয়েও যেন শেষ হচ্ছিল না পথ। মাঝে এক পাহাড়ি পাড়াতে কিছুক্ষণ ব্রেক দিয়ে আবার শুরু করলাম হাঁটা। কিছুদূর যেতেই জুম চাষের আগুনে পোড়া গাছপালা শূন্য পাহাড়ি এলাকা দেখে মন খারাপ হলো।

পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটা চলতে থাকল। পার হয়ে যেতে থাকলাম একের পর এক পাহাড়। পথ যেন আর শেষ হয় না। ঘণ্টা দুয়েক হাঁটার পর একটা পাহাড়ি পাড়াতে এসে সাথে থাকা শুকনো খাবার খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় তিন ঘণ্টা টেকিংয়ের পর দূর থেকে শুনতে পেলাম ঝরনার কলকল শব্দ। অবশেষে দেখা পেলাম দুর্গম পাহাড়ের বুকে লুকোনো মাতাইতুয়ারি ঝরনার।

স্থানীয় ত্রিপুরা অধিবাসীদের কাছে মাতাইতুয়ারি পবিত্র স্থান। ত্রিপুরা ভাষায় মাতাই মানে হলো দেবতা আর তুয়ারী মানে ঝরনা তার মানে দেবতার ঝরনা। নিজেদের নানা প্রয়োজনে তারা এখানে পূজা দিতে আসে। ঝরনার সামনের বাঁশের মাচায় দেখা মেলে পূজার নানা অর্ঘ্যের। মাতাইতুয়ারি থেকে বয়ে চলা ঝিরির পানি স্থানীয়দের একমাত্র পানির উৎস। এই ঝরনার পানি এতই ঠাণ্ডা যে পা রেখেই আঁতকে উঠতে হয়। গোসল, ফটোসেশন আর প্রকৃতি উপভোগে কেটে গেল ঘণ্টা দুয়েক। অতঃপর ফেরার পালা।

পাহাড়ি পথে এলেও পূর্বপরিকল্পনা মতো আমরা ফিরলাম ঝিরি পথে। ঝিরি পথের এই ট্রেইলের নাম-ই হতংকুচো। পাহাড়ি গিরি পথের আড়ালে সূর্যের আলো এখানে ক্ষীণ হয়ে আসে। হিমশীতল পানি আর বড় বড় পিচ্ছিল বোল্ডার সমেত আমার দেখা অন্যতম অ্যাডভেঞ্চারাস ট্রেইল এই হতংকুচো। মাতাইতুয়ারিতে গোসল সেরে ফেরার পথে আমাদের যারা শুকনো কাপড় পরেছিল কিছুদূর এসেই উপলব্ধি করতে হলো কী ভুলটাই না করে ফেলেছে। পুরো গিরি পথেই কোমর পানি এমনকি কিছু কিছু জায়গায় গলা পর্যন্ত পানি। ক্যামেরা, মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পানি থেকে বাঁচাতে সবাই ব্যাগ মাথায় তুলে নিয়ে শরণার্থীদের মতো এগোতে থাকলাম। কোথাও কোথাও পা রাখার আগে লাঠি দিয়ে মেপে নিতে হচ্ছিল গভীরতা। পিচ্ছিল পাথরে বেশ কয়েকজন আছাড় খেলেও সৌভাগ্যক্রমে তা বড় কোনো দুর্ঘটনায় রূপ নেয়নি। তবে বলাবাহুল্য টিমের মধ্যে যারা ট্রেকিংয়ে নতুন ছিল তাদের জন্য পলাশ ভাই আর সঞ্জয় দা আবির্ভূত হয়েছিল ত্রাণকর্তা রূপে। অভিজ্ঞ বাকিরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়াতে ভালোভাবেই পাড়ি দেওয়া গেছে ট্রেইল। ট্রেইলের মাঝে গাছ নেমে আসা কুণ্ডলী পাকানো শেকড় ধরে ঝুলে টারজান অভিজ্ঞতাও নিয়ে ফেলল কেউ কেউ।

গিরিপথ একসময় শেষ হয়ে আসে আমরা এবার সমতল ঝিরির মাঝে বড় বড় পাথর যেখানে কোনো পানি নেই বা সামান্য ধারা আছে সেখান দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। ঝিরি পারি দিয়ে উপরে উঠতেই একটা পাড়ায় এসে পৌছাই। সাথে নিয়ে আসা ইন্সট্যান্ট নুডলস আর স্যুপ দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিয়ে আবার ট্রেকিং শুরু করলাম। পথ যেন আর শেষ হয় না। অবশেষে আরো কয়েকটা পাহাড় পারি দিয়ে সন্ধ্যার আগেই এসে পৌঁছাই দেবতাপুকুর। অনেকেই আরেক দফা গোসল সেরে নেয় এই সুযোগে। অতঃপর ফেরার পালা। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে জুমের আগুনে পুড়তে থাকা দূরের পাহাড় দেখতে দেখতে বিদায় জানাই হতংকুচো – মাতাইতুয়ারিকে।

যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে শ্যামলি, হানিফ, শান্তি পরিবহনের বাস খাগড়াছড়ি যায়। নন এসিতে ভাড়া পড়বে ৫২০ টাকা। খাগড়াছড়ি শহর থেকে চান্দের গাড়ি বা মাহেন্দ্র পাবেন নুনছড়ি যেতে। অথবা মাইসছড়ি এসেও মাহেন্দ্রতে নুনছড়ি যাওয়া যায়। বাকি পথ ট্রেকিং করেই যেতে হবে। গাইডের খরচ পড়বে কমবেশি ৫০০ টাকা।

কিছু ব্যাপার না বললেই নয়। দেবতা পুকুর ও মাতাইতুয়ারি স্থানীয়দের কাছে পবিত্র স্থান তাই ভ্রমণে পবিত্রতা বজায় রাখবেন দয়া করে। ট্যুরের আনুষঙ্গিক হিসেবে সঙ্গে রাখতে হবে শুকনো খাবার, পানি, টর্চ, টেলিটক অথবা রবি সিম এবং এক্সট্রা পলিথিন। দয়া করে ভুলেও সাথে নিয়ে যাওয়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো অপচনশীল দ্রব্য বা প্যাকেট ফেলে আসবেন না।

 

Leave a Comment