জার্নি টু চেন্নাই এপোলো 02/12/2018


বাংলাদেশ থেকে শুধু ভারতেই চিকিৎসার জন্য  বছরে পাঁচ থেকে ছয় লাখ মানুষ যায়। সম্প্রতি পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেলো এ তথ্য। হিসাবটা কিন্তু ভয়াবহ! এত রোগী ভারতে যাচ্ছে মানে দেশের সব অর্থ চলে যাচ্ছে পাশের দেশে! এ লেখার বিষয় বাংলাদেশ কিংবা ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে নয়। লেখাটি তাদের জন্য, যারা ভারতে চিকিৎসা সেবা নিতে চান। বিশেষ করে ভারতের চেন্নাই এপোলো হাসপাতালে। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই লিখছি।

চেন্নাইয়ের এপোলো পার্সোনালাইজড হেলথ চেক অত্যন্ত নামকরা হাসপাতাল। বাংলাদেশের খুবই কাছে কলকাতায়ও এপোলো আছে। কিন্তু চেন্নাইয়ের শাখাটিকে বলা হয় সেরা। জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে আপনারা জার্নি শুরু করবেন চেন্নাই এপোলো পর্যন্ত।

 

প্রথম শর্ত
চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হলে প্রথমেই পাসপোর্ট থাকতে হবে। একইসঙ্গে কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করে কাছে রাখুন। আপনি যে বাসায় থাকেন, সেখানকার একটি বিদ্যুৎ বিলের কপি রাখুন। ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করুন।

 

চিকিৎসক নির্বাচন করুন
চেন্নাই এপোলোর ওয়েবসাইট অত্যন্ত আধুনিক। সেখানে নিজের রোগ অনুযায়ী কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাবেন, তাকে নির্বাচন করুন। হাসপাতালের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিভাগের ইমেইল ঠিকানা আছে। সেখানে ইমেইল করতে পারেন— appointment@apollohospitals.com, ips_chennai@apollohospitals.com।

ইমেইলে আপনার রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। বাংলাদেশে আপনার সবশেষ করা টেস্টগুলো ও পাসপোর্টের স্ক্যান কপি ইমেইলে সংযুক্ত করুন। একইসঙ্গে কোন চিকিৎসক দেখাতে চান অর্থাৎ কবে-কখন-কার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে চান সেই বিষয়ে লিখে পাঠান। সাধারণত দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে আপনার ইমেইলের জবাব পেয়ে যাবেন। কোনও কারণে ইমেইলের জবাব না পেলে সরাসরি ফোন করুন। এর মধ্যেই আপনার কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার চলে আসবে।

 

ভিসার আবেদন
এবার ভারতীয় ভিসার আবেদন করতে হবে। রাজধানীর বারিধারা-বসুন্ধরায় অবস্থিত যমুনা ফিউচার পার্কে ভারতের সর্ববৃহৎ ভিসা আবেদন কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে যোগাযোগ করে চলে যান। মনে রাখবেন, ভিসার আবেদনের সঙ্গে আপনার বেশ কয়েকটি ডকুমেন্ট লাগবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
১. ভিসা ফর্ম পূরণের কপি ও পেমেন্ট কনফার্মেশন।
২. বিদ্যুৎ বিলের কপি।
৩. জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) কপি।
৪. বাংলাদেশে যে চিকিৎসককে দেখিয়েছেন তার একটি সুপারিশ লেটার। (অনেকেই বলেন এই চিঠি না থাকলেও চলে। কিন্তু এই চিঠি থাকা ভালো। এতে ভিসা পাওয়ার নিশ্চয়তা বেশি থাকে)
৫. বাংলাদেশে গত ছয় মাসে করানো টেস্টগুলোর রিপোর্টের কপি।
৭. চাকরিজীবী হলে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ (এনওসি) লাগবে। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাগজ নিতে হবে।
৮. ভারতের নির্বাচিত হাসপাতাল থেকে পাঠানো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের কপি।
৯. ব্যাংক থেকে ডলার এনডোর্সমেন্টের কপি। কমপক্ষে ২০০ ডলার।
১০. ছয় মাসের ব্যক্তিগত ব্যাংক স্টেটমেন্ট।
১১. দুই গুণ দুই ইঞ্চি মাপের এক কপি রঙিন ছবি ফর্মের ডানপাশে নির্ধারিত ঘরে যুক্ত করতে হবে।

এসব কাগজপত্র নিয়ে ভারতীয় ভিসা অফিসে যেতে হবে। পরবর্তী করণীয় বা দিকনির্দেশনা তারাই জানিয়ে দেবে।

 

এয়ারটিকেট অথবা বাস-ট্রেন
বাস কিংবা ট্রেনে চেন্নাইয়ে যাওয়া অনেক সময়ের ব্যাপার। অবশ্য এক্ষেত্রে খরচ কম পড়ে। বাস কিংবা ট্রেনে ঢাকা থেকে কলকাতা। তারপর কলকাতা থেকে চেন্নাইয়ে ট্রেনে। এই ট্রেন জার্নিতে লাগে ৩২ ঘণ্টা। অনেকের কাছেই শোনা— ট্রেনে গেলে চমৎকার একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়। আর অন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা ট্রেনে চড়েই উপভোগ করা যায় বেশি।

তবে এয়ার অর্থাৎ বিমানে গেলে অল্প সময়ের মধ্যে চেন্নাই পৌঁছানো সম্ভব। বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত সরাসরি চেন্নাই যায় মালদিভিয়ান্স এয়ারলাইন্স। এখানে আপনার রাউন্ড ট্রিপে খরচ পড়তে পারে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা (সময় অনুযায়ী ভাড়ায় তারতম্য থাকতে পারে। কমেও হয়ে যেতে পারে ট্রিপ)। মালদিয়াভিয়ান্সে একটা সমস্যা হলো, মেডিক্যাল ভিসা হলে আলাদা একটি ফর্ম পূরণ করতে হয়। তারা সেটা মালদ্বীপ পাঠায়। সেখান থেকে ক্লিয়ারেন্স এলেই ভ্রমণ করতে পারবেন। এ বিমানে উঠে মাত্র আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে চেন্নাই পৌঁছানো যায়।

অন্যদিকে খরচ কমিয়ে ট্রানজিট নিয়ে চেন্নাই পৌঁছাতে পারেন বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্সে। ঢাকা থেকে যেকোনও বিমানে কলকাতা। তারপর সেখান থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইট ধরে চেন্নাই। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ নিজের। সময় বাঁচাতে চাইলে সরাসরি যাত্রা করতে পারেন। যদি সময় ও অর্থ দুটোর কথাই একটু ভাবেন, তাহলে ট্রানজিট নিতে পারেন। আর যদি মনে করেন, যাত্রায় বেশি অর্থ খরচ না করে চিকিৎসার জন্য অর্থ জমিয়ে রাখবেন তাহলে ট্রেন ভ্রমণই সবচেয়ে শ্রেয়। এক্ষেত্রে মেডিক্যাল ভিসার ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে, লম্বা জার্নিতে রোগীর যন্ত্রণা আরও বেড়ে যেতে পারে।

 

 

চেন্নাই জার্নি শুরুর আগে
১. যেকোনও নতুন স্থানে যাওয়ার আগে ইন্টারনেট ব্যবহার করে সেই স্থান সম্পর্কে জেনে নিন। সেখানকার সংস্কৃতি ও জায়গাগুলো সম্পর্কে জেনে নিলে সুবিধা হবে।

২. এপোলোর রোগী হয়ে থাকলে আগে থেকেই এপোলোকে বলে রাখতে হয় কবে ও কখন চেন্নাই পৌঁছাবেন। এপোলো সাধারণত বিদেশি রোগীদের জন্য ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করে রাখে। এই সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। আপনি যে গন্তব্যে যাবেন সেই ঠিকানা লিখে রাখুন। এপোলোর আশেপাশেই কোনও হোটেলে থাকার চেষ্টা করবেন।

৩. আপনি কবে পৌঁছাবেন সেই বিষয়ে এপোলোতে ইমেইল করে বিস্তারিত জানাবেন। তাদের কাছ থেকে কনফার্মেশন নেবেন যে, তারা আপনার জন্য ট্রান্সপোর্ট পাঠাচ্ছে।

 

জার্নি টু চেন্নাই
জার্নি শুরু করে চেন্নাই পৌঁছালেন। মনে রাখবেন, সেখানে গিয়েই ধাক্কা খাবেন! মনে হবে একটুকরো বাংলাদেশের মতোই। শুধু ভাষা অন্য। চেন্নাইয়ের মধ্যবিত্ত মানুষগুলো অনায়াসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। তাদের কাছ থেকে যেকোনও সহায়তা পাবেন। চেন্নাই পৌঁছে কিছু বিষয় মনে রাখবেন—
১. এয়ারপোর্ট থেকে ডলার অনেক কম মূল্যে কিনতে হয়।
২. অপরিচিত কাউকে সহজেই বিশ্বাস করবেন না।
৩. আগে থেকে কোনও হোটেলে যোগাযোগ করে রাখা ভালো। কারণ দুটি— সেখানে কোথায় উঠছেন সেই ঠিকানা লিখতে হবে ইমিগ্রেশনে এবং ঠিকানা সম্পর্কে নিজেরও নিশ্চয়তা থাকবে।
৪. বিমানবন্দর থেকে বের হলেই দেখবেন সাদা পোশাকে ট্যাক্সি ড্রাইভার আপনার নামের প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বিশ্বাস করতে পারেন। কারণ তার কাছে আপনি এপোলোর অতিথি।

চেন্নাইয়ের গ্রিমস রোডে অবস্থিত এপোলো। এর খুব কাছেই ম্যাকিস গার্ডেনে প্রচুর হোটেল ও রেস্টহাউজ আছে। বিশেষ করে রামাসামি রোডে চোখে পড়বে পুরোপুরি বাঙালি আমেজ। বাজেট বেশি থাকলে চেন্নাই গিয়ে নামিদামি হোটেলে থাকুন। এটা ব্যক্তিগত বিষয়। থাকার বিষয়ে কিঞ্চিৎ কিপটে হয়ে চিকিৎসার খরচে মনোযোগী হওয়া মধ্যবিত্তদের জন্য ম্যাকিস গার্ডেনের আশেপাশে থাকা ভালো হবে। এতে করে সহজে এপোলো যাওয়া যাবে। আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। খরচও হাতের নাগালে থাকবে। নন-এসি ৯০০ থেকে ১১০০ রুপি ও এসি ২ হাজার রুপির মধ্যে ভালো রুম মিলবে।

সেসব হোটেলে রয়েছে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থাও। নিজের মতো বাজার করে রান্না করা যায়। চেন্নাইয়ের রান্নায় আপনার স্বাদ নাও লাগতে পারে। এপোলোর আশেপাশে প্রচুর খাবার হোটেল রয়েছে। ‘বাঙালি খাবার পাওয়া যায়’— এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছে যারা, তাদের রান্নার স্বাদ তৃপ্তিময় নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে নিজে নিজে রান্না করে খেতে পারেন।

চেন্নাইয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা অটোরিকশা চালকরা। যেহেতু তারা জানে প্রচুর রোগী সেখানে আসে, তাই তারা দেখেই বলে দিতে পারে, কে পর্যটক আর কে স্থানীয়। তাই ঠকানোর বহু চেষ্টা করবে তারা। অনেক সময় অটোরিকশায় জনপ্রতি ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করে চালকরা। এক্ষেত্রে সাবধানী হওয়ার বিকল্প নেই। জনপ্রতি কোনও হিসাব নেই তাদের, কিন্তু লোক ঠকাতে তারা এই প্রচেষ্টা চালায়। কোনও স্থানে ঘুরতে যাওয়ার আগে গুগল ম্যাপে দেখে নেবেন দূরত্ব কতটুকু হতে পারে। সেই হিসেবে ভাড়া বোঝার চেষ্টা করবেন। এছাড়া যে হোটেলে উঠেছেন, সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও ভাড়ার বিষয়ে কথা বলে নিতে পারেন। তাহলে একটা অনুমান হবে।


 

এপোলোর চিকিৎসা
এপোলোর চিকিৎসা দ্রুতগতিতে হয়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট যেদিনই থাকুক না কেন, চেন্নাই পৌঁছানোর পরদিন সকালেই হাজির হবেন এপোলোতে। যাওয়ার আগে পাসপোর্টের কপি ও মেডিক্যাল ভিসার কপি নিয়ে যাবেন। সেখানে গিয়ে আন্তর্জাতিক ডেস্কে যোগাযোগ করবেন। শুরুতে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধন হলেই চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এপোলোতে অনেক চিকিৎসকের কক্ষে বাঙালি একজন সহযোগী থাকেন। সুতরাং ইংরেজিতে স্বাচ্ছ্ন্দ্যবোধ না করলে সহযোগীর কাছে রোগের বিস্তারিত জানান। পুরনো রিপোর্টগুলো দেখান। কিছু কিছু চিকিৎসককে ইংরেজিতেও বোঝানোর চেষ্টা করবেন। বাংলা ভাষা জানা কেউ না থাকলে ট্রান্সলেটর লাগবে জানালে চিকিৎসকই ব্যবস্থা করে দেবেন। শারীরিক কোনও টেস্ট লাগলে তিনি টেস্ট করতে দেবেন। টেস্টগুলোর রিপোর্ট খুব দ্রুতই এপোলো আপনাকে সরবরাহ করতে সক্ষম। কোনও রিপোর্ট যদি দেরি হয় ও ততদিনে আপনার দেশে ফেরার সময় হয়ে গেলে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ডেস্কে জানিয়ে এলে ইমেইলে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেবে তারা। সেই রিপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন চিকিৎসককে ইমেইল করলে তিনি একসপ্তাহের মধ্যে উত্তর দেওয়ার কথা।

একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, চেন্নাই এপোলো খুব দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া শুরু করে। এজন্যই এটিকে বলা হয় খরুচে হাসপাতাল। চেন্নাইয়ের ভেলোর সিএমসি এমনকি চেন্নাইয়ে আরও ভালো কয়েকটি হাসপাতাল রয়েছে। গুগলে ঢুকে সেসব সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন।

Credit:- শেরিফ আল সায়ার 

Source:- বাংলা ট্রিবিউন

Leave a Comment